রাতে
কেমন জানি তেমন ঘুম হল না যদিও একটু দেরিতে ঘুমিয়ে ছিলাম রাত প্রায় দেড়টা। কারণ ঘুম থেকে উঠতে হবে সকাল সকাল চতুরদিকে মসজিদ বেষ্টিত
বাসা হওয়ায় ফযরের আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গল। অন্য কোনদিন আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গলে শয়তানের
সহযোগিতায় ঘুমির তীব্রতা আরও বেড়ে যায় আজ একটু ব্যতিক্রম উঠে পড়লাম উষ্ণ বিছানা ছেড়ে। মাঘ মাসের কণকণে শীত।
গোসল
ও প্রকৃতির ডাক ছেড়ে নামায টা শেষ করতে না করতেই ক্রিং ক্রিং ক্রিং সেই বিখ্যাত নকিয়ার
রিং টুনের আওয়াজ কানে ভেসে আসল “ভাই জান আমরা আপনার অফিসের সামনে অন্য গাড়ীটি বিবিরহাট
ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দিছি” কথা বলছিলাম বাস ড্রাইভারের সাথে । যাক প্রতিবার গাড়ী আসতে বিলম্ব করলেও এবার তাদের দায়িত্বজ্ঞানের
প্রসংশা না করে পারলাম না। পাঠক বুঝতে পারছেন আমরা কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি
নিচ্ছি। হ্যা, প্রগ্রেসিভ একাডেমীর ২০১৩ সালের শিক্ষা সফর নাজিরহাট
টু বাঁশখালী ইকুপার্ক। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞায় দেখেছি ভ্রমণ ও শিক্ষা সফর
মানে অনেকগুলি সমস্যার সমষ্টি যার ভিতর লুকানো আছে আনন্দ আর অনুভুতিগুলো। যাত্রা শুরু করার শেষ সময় সকাল ৭টা কিন্তু এখন ৬টা ৪৪ মিনিট
হাতেগনা কয়েকজন ভ্রমণ পিপাসু শিক্ষার্থী ও দুটি বাস ছাড়া আর কারও দেখা নেই। হঠাৎ মনে পড়ল মাইক ম্যাগনিশিয়ান কে তাই ভাবলাম ফোন করি, এ কি? একটি মেয়ে কুকিল কন্ঠে বলল “ এই মুহুর্তে আপনার কাঙ্কিত নাম্বারটি বন্ধ আছে
অনুগ্রহ করে একটু পর আবার চেষ্টা করুন” । সমস্যা শুরু এক স্টুডেনকে তার বাসায় পৌছালাম ছাত্রটি চালাক
হওয়াতে মাইক নিয়ে আর জামালায় পড়তে হল না। সময় এখন ৭.৩০মিনিট। হায়! এখনও স্বেচ্ছা সেবকদের অনেকে উপস্থিত হয়নি
। যা হোক উপস্থিত স্বেচ্ছা সেবকরা কাজ শুরু করে দিয়েছে ব্যানার
টাঙ্গানো, ডেকেরেশনের মালামাল ও খাবারের দ্রব্যাদি গাড়ীতে উঠানো ইত্যাদি
ইত্যাদি। আবারও ক্রিং ক্রিং আওয়াজ “হ্যালো, স্যার আমরা বিবিরহাট থেকে দুজন ছাড়া বাকী সবাই
উপস্থিত একজনের মোবাইল বন্ধ আরেক জনের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। আমরা কী চলে আসব ? চলে আস।” কথা বললাম বিবিরহাট ব্রাঞ্চের ম্যানেজার জনাব শওকত
আলীর সাথে । সবাই ইতোমধ্যে প্রগ্রেসিভ একাডেমীর প্রধান শাখার
সামনে ঘুরা ফেরা করছে । এক বয়স্ক মুরব্বি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “ ভাই কার সাথে কথা বলব বুঝতে পারছি না এখানের প্রধান
কে?” বললাম
“আমি,কিন্তু কেন” আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর বলল
চাল আরও চার কেজি বেশি লাকবে সবাই এক বয়সের হওয়াতে খাবার শর্ট হতে পারে।” লম্বায় একটু খাট হওয়ায় সবাই আমাকে চিনতে প্রায়
ভুল করে এতে আমি একটু আনন্দ উপভোগ করি। পরে জানতে পারলাম মুরব্বিটা আমাদের বাবুর্চি। সময় এখন ৮টার বেশি। তিনটি গাড়ীর মধ্যে গাড়ী নং -২২৩৩ এ দায়িত্ব দিলাম
ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জনাব আনোয়ার সাহেব কে, গাড়ী নং -১৯৭২ এ দায়িত্ব দিলাম শওকত সাহেব কে আর
গাড়ী নং -১৯৭৫ এ দায়িত্ব নিলাম আমি নিজেই। প্রত্যেককে নিজ দায়িত্বে লটারীর মাধ্যমে সবাইকে
গাড়ীতে তুলে নিল। ছাত্রদের মধ্যে আনন্দের উৎসব মূখর পরিবেশ লক্ষ্য করলাম। আবার সমস্যা, ২২৩৩ নং গাড়ীর ড্রাইভার এসে বলল ভাই আমার গাড়ীর কিছু সমস্যা
দেখা দিচ্ছে পথে বিপদ হতে পারে আপনারা অন্য একটি গাড়ী ব্যবস্থা করেন। কথায় আছে সময়ের এক ফোঁড় অসমেয় দশ ফোঁড়। বললাম ভাই এই মুহুর্তে আমার পক্ষে গাড়ী ব্যবস্থা করা সম্ভব
না আপনি কিছু একটা করেন । লোকটি আমার অসহায়ত্ত দেখে নাজিরহাট বাস স্ট্যান্ডে
ফোন করলে নতুন গাড়ী এক হাজার টাকা বেশি চাচ্ছে তাই সেটি বাদ দিল। আবার ফোন করল বিবিরহাট বাস স্ট্যান্ডে, যা হোক একটি বাস পাওয়া গেল। অপেক্ষা করলাম প্রায় আধা ঘন্টা।
সবাই
হৈ চৈ করতে লাগল বাস ছাড়ে না কেন? সবাইকে বুঝালাম গাড়ীর ইঞ্জিনের গোলযোগের কারণে
যাত্রা কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে আমরা শীঘ্রই রওনা দিচ্ছি। এখন সময় ৯টা। আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত তাই দেরি না করে ড্রাইভারদের
নির্দেশ দিলাম গন্তব্যের দিকে রওনা দিতে। গাড়ী চলতে লাগল একটু রিলেক্্র নিয়ে বসলাম। চিন্তা করলাম আনন্দটা সবার সাথে শেয়ার করব তাই প্রত্যেক গাড়ীতে
১৫ থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত সময় দিচ্ছি । ফোনটা বেজে উঠল দেখলাম ২২৩৩ নং গাড়ী থেকে আনোয়ার
সাহেবের ফোন, “আমরা গাড়ীর খাদ্য জ্বালানী নিচ্ছি পেট্রোল পাম্প থেকে আপনারা
একটু আস্তে যান যাতে তিনটি গাড়ি একসাতে চলে।” বললাম ঠিক আছে আমরা সামনে অর্থাৎ ভার্সিটি ২ং গেইট সংলগ্ন পেট্রোল পাম্পে দাড়াব। অপর গাড়ী দু’টি খাবার খেতে ব্যস্থ এ সুযোগে অনেকে গাড়ী থেকে
নেমে শৌচাগারে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সারতে ব্যস্থ হয়ে পড়ল। যাক বাস তিনটি নিজের খাবার খেয়ে নিল যাতে দুপুরে আর লান্স
করতে না হয়। আমরা এখন এক সাথে চলছি মাইকের আওয়াজে আশপাশের পরিবেশ
আমাদের আনন্দ উপভোগ করতেছে। আমিও খুব আনন্দিত। আনন্দ যে বেশিক্ষণ থাকে না তা আগে থেকেই জানতাম “আবার কি হল? স্যার, আমাদের মাইকটি নষ্ট গান করতে পারছিনা।” কথা বলছিলাম ১৯৭৫ নং গাড়ী থেকে একজন ছাত্রের সাথে। তাড়াতাড়ি শওকত ও ইকবালকে আদেশ করলাম ত্রুটি বের করে দ্রুত
সমাধান করতে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম বিফল হল না যদিও তার কেউ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি নন। সবকিছু ঠিকঠাক সম্পূর্ণ শান্ত গতিতে চলতে লাগল গাড়ীগুলো। যে সমস্ত ছাত্ররা গান করতে পারে তারা স্পিকার সামনে পেয়ে
নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। কারও কারও কন্ঠ খুবই লাগেছে আমার কাছে। তাদের কে উৎসাহ দিতে মাঝে মাঝে নিজেই গান আর কৌতুক করতেছি ওদের সাথে। ১২ টায় আমাদের গন্তব্য স্থলে পৌছার কথা থাকলেও এখন প্রায়
১টা, সবে
মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা পার করলাম। এখন আমরা বাঁশখালী সদর অতিক্রম করতেছি। গাড়ীর গতিবেগ কেমন যেন হঠাৎ কমে গেল, না গাড়ীর সমস্যা নয় সমস্যা রাস্তার। রাস্তার অবস্থা দেখে মনে মনে চিন্তা করলাম এটা জানতে পারলে
এখানে আসতাম না। যা হোক নিজের দুর্বলতা কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। অবশেষে ১ টা ৪৫ মিনিটে পৌছলাম আমাদের সেই কাঙ্কিত বাঁশখালি
ইকুপার্কে। বাহ! সুন্দর একটি ছোট মাঠ ও সাথে একটি যাত্রী চাউনি থাকায়
আমাদের অবস্থান করতে তেমন কষ্ট হয়নি। সবার মধ্যে কিছুটা ক্লান্তি বোধ লক্ষ্য করলাম। দ্রুত নির্দেশ দিলাম সবাইকে নাস্তা বিতরণ করতে আর বাবুর্”ি কে বললাম যত দ্রুত সম্ভব খাবার রান্না করতে। নাস্তা শেষে সবাইকে একত্রিত করে একটা ভাষণ দিলাম পরবর্তী
কার্যক্রম সম্পর্কে। সবাইকে সময় দিলাম পৌন এক ঘন্টার মধ্যে পার্ক পরিদর্শন
করার জন্য। বাঙ্গালীদের ঐতিহ্যগতভাবে সময়জ্ঞান ও দায়িত্বজ্ঞান কম থাকায়
সময় কম দিলাম। তারা ঐতিহ্যগত অভ্যাসকে অবজ্ঞা করতে মোটেই অভ্যস্থ
নন তাই ফিরে আসল তার দ্বিগুণ সময় ব্যয় করে। অর্থাৎ সাড়ে তিনটায়। অনেকে ফিরতে বেশি দেরি করেছিল তাই প্রত্যেক ভুলের
মাশুল হিসেবে আমার বকা খাওয়া থেকে বাদ পড়েনি। একদিকে লান্সের সময় পার হওয়া অন্যদিকে উচু নিচু
পাহাড় বেয়ে উঠার কারণে সবার ক্ষুুধার তীব্রতা যে দ্বিগুণ হল সেটা তাদের মুখ দেখলে বুঝা
যাচ্ছে। মনে করছিলাম খাবের পূর্বে খেলাধুলা শেষ করব কিন্তু ডিপুটি
ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জনাব ফরহাদ হোসেন আপত্তি
করল যে, খাবার আগে তারপর খেলাধুলা। ভ্রমণের মধ্যে এক’শতর বেশি ছাত্রদের খাবার পরিবেশন সত্যিই কঠিন। কী করি? হঠাৎ মনে পড়ল সেই ছোট বেলার মেজবানের কথা, ছোটদেরকে বাঁেশর তৈরী পাটিতে এবং বড়দেরকে চেয়ারে
বসায়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। কিন্তু আজ আমরা বড় হলেও চেয়ার নাই। তাই সবুজ ঘাসের উপর সবাইকে মেঝবানের ন্যায় বসে পড়তে বললাম। স্বেচ্ছাসেবকরা সুদক্ষতার সহিত মাত্র কয়েক মিনিটে সবার সামনে
খাবার পৌছিয়ে দিল। আমরা শিক্ষকরাই তাদেরকে খাওয়াতে ব্যস্থ হয়ে পড়লাম। খাবার গরম হওয়াতে খেয়ে সবাই সন্তুুষ্ট। কয়েক মিনিটে আমরাও লান্স করে ফেলছি। খাবারের পরে সবার মলিন মুখটা হাস্যজ্বল মনে হল। সময় এখন প্রায় ৫টা। এখনও অনেক কাজ বাকী, ক্রিকেট খেলার জন্য দ্রুত টীম গঠন করলাম প্রধান
শাখা বনাম বিবিরহাট শাখা । টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সামান্য ব্যবধানে বিজয়
ছিনিয়ে আনল বিবিরহাট ব্রাঞ্চ। তাদের আনন্দ উল্লাসে প্রধান শাখার ছাত্ররা খুবই
ঈর্ষান্বিত হল। এবার কুইজ প্রতিযোগীতার পালা সবাইকে একটি করে কলম
ও কুইজ দেওয়া হল ৫মিনিটের মধ্যে ক্ইুজের উত্তর দেয়ার জন্য। কুইজের ফলাফল রেডি করতে ব্যস্থ হয়ে পড়ল শিক্ষকগণ আর আমি সবাই
নিয়ে শুরু করলাম মামা ভাগিনার খেলা। মামা ভাগিনার খেলার দৃশ্য দেখে কেউ হাসি চেপে রাখতে
পারিনি। চারিদিকে হাসির কলরল। স্থানীয় বাসিন্দিা ও কর্তব্যরত কর্মকর্তাগণ আমাদের
খেলাধুলা উপভোগ করছিল। তাদের অংশগ্রহণ আমাদের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎ কানে কানে কেউ একজন বলল স্যার সন্ধা হয়ে যাচ্ছে একটু তাড়াতাড়ি
করুন। সন্ধার আগমণ লক্ষ্য করে পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ও সমাপণী
বক্তৃতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার সফরের ইতি টানলাম । রাত সাড়ে দশটায় আমরা আল্লাহর অসেশ রহমতে ফিরে আসলাম
আমাদের নিবাসে। এই শিক্ষা সফর কে সার্থক ও সুন্দর করার জন্য সকলের
কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সেই সাথে ধন্যবাদ জানাচ্ছি পাঠকদের কে আমার এই লেখা কষ্ট
করে পড়ার জন্য।
শুভেচ্ছান্তে
মুহাম্মদ
ওসমান গণী