ইসলামের মূল পাঁচ ভিত্তির একটি হল রমজান মাসের রোজা। মুসলমানদের প্রিয় মাস " মাহে রমজান "। সর্বসেরা মাসও এটি। এই রমজান আসে মুমিনের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে। এই রমজান আসে রহমতে পরিপূর্ন করে দিতে। একটি মানুষকে নিষ্পাপ বানিয়ে দিতে। রমজানে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য থাকে অনেক অফার। মহান মনীবের নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম এই রমজানের রোজা। তাই সকল মুমিন, মুসলমান এই মাসটির অপেক্ষায় থাকে। দীর্ঘ এগারো মাস অপেক্ষার পরে রজমানে আমাদের মাঝে উপস্থিত। আমরা রমজানকে স্বাগতম জানাচ্ছি " আহলান সাহলান ইয়া শাহরু রমাদান"।
রমজান মাসের রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ। আমরা যেন আল্লাহ ভীতি অর্জন করতে পারি সে জন্য এই রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে। এই রোজা আমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ও ফরজ ছিলো। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ "হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ।যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার ।(সূরা বাকারা:১৮৩)
আরো এরশাদ হয়েছে-”তোমাদের মধ্যে যে (রমযান) মাসকে পায়, সে যেন রোযা রাখে” (বাকারা ১৮৫)
হযরত সালমান (রাঃ) হতে বণিত আছে, তিনি বলেন প্রিয় নবীয়ে করীম (সাঃ) শাবানের শেষ তারিখে আমাদেরকে নসীহত করেছেন যে, তোমাদের মাথার উপর এমন একটি মর্যাদাশীল মুবারক মাস ছায়া স্বরুপ আসছে, যার মধ্যে শবেকদর নামে একটি রাত্রি আছে, যা হাজার মাস হতেও উত্তম। আল্লাহ তায়ালা সে মাসের রোযা তোমাদের উপর ফরয করেছেন এবং রাত্রি জাগরণ অর্থাৎ তারাবী পড়াকে তোমাদের জন্য পুন্যের কাজ করেছে। যে ব্যক্তি এমাসে কোন নফল কাজ আদায় করল, সে যেন রমযানের বাহিরে একটি ফরয আদায় করল। আর যে এমাসে একটি ফরয কাজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করল।
যাদের উপর রোযা ফরজঃ প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক,বালেগ, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, মুকিম, সামর্থ্যবান মুসলিমের জন্য সিয়াম পালন ফরজ।
যাদের উপর রোযা ফরজ নাঃ দশ প্রকার মানুষের জন্য রোযা ফরজ না।
১. কাফের বা অমুসলিম। কারণ তারা ইবাদত করার যোগ্যতা রাখে না। ইবাদত করলেও ইসলামের অবর্তমানে তা সহি হবে না, কবুলও হবে না। যদি কোন কাফের রমজানে ইসলাম গ্রহণ করে তবে পিছনের সিয়ামের কাজা আদায় করতে হবে না।
২. অপ্রাপ্ত বয়স্ক। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার সিয়াম পালন ফরজ নয়।
৩. পাগল। পাগল বলতে বুঝায় যার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। যার কারণে ভাল-মন্দের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। এর জন্য সিয়াম পালন ফরজ নয়। যেমন পূর্বের হাদিসে উলে¬খ করা হয়েছে। পাগল যখনই সুস্থ হয়ে যাবে তখনই সে সিয়াম পালন শুরু করে দেবে। যদি এমন হয় যে দিনের কিছু অংশ সে সুস্থ থাকে কিছু অংশ অসুস্থ তাহলে সুস্থ হওয়া মাত্রই সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। সিয়াম পূর্ণ করবে। পাগলামি শুরু হলেই তার সিয়াম ভঙ্গ হবে না, যদি না সে সিয়াম ভঙ্গের কোন কাজ করে।
৪.অশীতিপর বৃদ্ধ যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না । এ ব্যক্তি যার বয়সের কারণে ভাল-মন্দ পার্থক্য করার অনুভূতি চলে গেছে সে শিশুর মতই। শিশু যেমন শরিয়তের নির্দেশমুক্ত তেমনি সেও। তবে অনুভূতি ফিরে আসলে সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। যদি তার অবস্থা এমন হয় যে কখনো অনুভূতি আসে আবার কখনো চলে যায় তবে অনুভূতি থাকাকালীন সময়ে তার উপর সালাত, সিয়াম ফরজ হবে।
৫.যে ব্যক্তি সিয়াম পালনের সামর্থ্য রাখে না। এমন সামর্থ্যহীন অক্ষম ব্যক্তি যার সিয়াম পালনের সামর্থ্য ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। যেমন অত্যধিক বৃদ্ধ অথবা এমন রোগী যার রোগ মুক্তির সম্ভাবনা নেই—আল্লাহ্র কাছে আমরা এ ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে আশ্রয় চাই। এ ধরনের লোকদের সিয়াম পালন জরুরি নয়। কারণ সে এ কাজের সামর্থ্য রাখে না।
৬.মুসাফির। মুসাফিরের জন্য সিয়াম পালন না করা জায়েজ আছে। সফরকে যেন সিয়াম পালন না করার কৌশল হিসেবে ব্যবহার না করা হয়।
৭.যে রোগী সুস্থ হওয়ার আশা রাখে।
৮. যে নারীর মাসিক চলছে। ঋতুকালীন সময়ে নারীর জন্য সওম পালন জায়েজ নয় বরং নিষেধ।
৯. গর্ভবতী ও দুগ্ধ দানকারী নারী। যদি গর্ভবতী বা দুগ্ধ দানকারী নারী সিয়ামের কারণে তার নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করে তবে সে সিয়াম ভঙ্গ করতে পারবে। পরে নিরাপদ সময়ে সে সিয়ামের কাজা আদায় করে নিবে।
১০. যে অন্যকে বাঁচাতে যেয়ে সিয়াম ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয়। যেমন কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি ; পানিতে পড়ে যাওয়া মানুষকে অথবা আগুনে নিপতিত ব্যক্তিকে কিংবা বাড়িঘর ধসে তার মাঝে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে যেয়ে সিয়াম ভঙ্গ করল।
যে সকল কারনে রোযা ভঙ্গ হয়ঃ
১। রোযা স্মরণ থাকা অবস্থায় পানাহার করা কিংবা স্ত্রী সহবাস করা।এতে কাযা ও কাফফারা (একাধারে দুই মাস রোযা রাখা) ওয়াজিব হয়।
২। নাকে বা কানে তেল, ষধ ইত্যাদি প্রবেশ করানো।
৩। নস্যি গ্রহণ করা।
৪। ইচ্ছকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করা।
৫। বমি আসার পর তা গিলে ফেলা।
৬। কুলি করার সময় বা যে কোন ভাবে পানি গলার ভিতরে ঢুকে পড়া।
৭। দাঁতে আটকে থাকা ছোলা বা তার চেয়ে বড় ধরনের খাদ্যকণা গিলে ফেলা।
৮। মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে পড়া অবস্তায় সুবহে সাদেকের পর জাগ্রত হওয়া।
৯। ধুমপান করা।
১০। রাত্র মনে করে সুবহে সাদেকের পর সাহরী খাওয়া।
১১। সূর্যাস্তের পূর্বে সূর্য অস্তমিত হয়েছে ভেবে ইফতার করা। এগুলোতে শুধু কাযা (যে কয়টা ভাংবে সে কয়টা পরবর্তিতে রাখতে হবে)ওয়াজিব হয় । কাফফারা নয় ।কিনতু রোযা ভেঙ্গে যাওয়ার পর দিনের অবশিষ্ট সময় রোযাদারের ন্যায় পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
১। মিথ্যা কথা বলা।
২। গীবত বা চোগলখোরী করা।
৩। গালাগালি ও ঝগড়া ফাসাদ করা।
৪। সিনেমা দেখা বা অন্য কোন কবিরাহ গুনাহে লিপ্ত হওয়া।
৫। সারাদিন নাপাক অবস্থায় থাকা।
৬। রোযার কারনে অস্থিরতা বা কাতরতা প্রকাশ করা।
৭। কয়লা, মাজন, টুথ পাউডার, টুথ পেষ্ট বা গুল দিয়ে দাঁত মাজা।
৮। অনর্থক কোন জিনিস মুখের ভিতর দিয়ে রাখা।
৯। অহেতুক কোন জিনিস চিবানো বা চেখে দেখা।
১০। কুলি করার সময় গড়গড়া করা।
১১। নাকের ভিতর পানি টেনে নেয়া (কিন্তু সে পানি গলায় পৌছে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে)
১২। ইচ্ছকৃতভাবে মুখে থু থু জমা করে গিলে ফেলা ।
১৩। ইচ্ছকৃতভাবে অল্প বমি করা
যে সকল কারনে রোযার ক্ষতি হয়নাঃ
১। ভুলক্রমে পানাহার করা।
২। আতর সুগন্ধি ব্যবহার করা বা ফূল ইত্যাদির ঘ্রাণ নেওয়া।
৩। নিজ মুখের থু থু কফ গিলে ফেলা।
৪। মাথা ,শরীর বা মুখে তেল, ক্রিম ,লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করা।
৫। ঠান্ডার জন্য গোসল করা।
৬। ঘুমে স্বপ্নদোষ হওয়া।
৭। মিসওয়াক করা।
৮। অনিচ্ছকৃতভাবে বমি হওয়া।
৯। চোখে ওষধ , সুরমা বা ড্রপ ব্যবহার করা(খুব প্রয়োজন হলে)।
১০। ইনজাকশন নেয়া (খুব প্রয়োজন হলে)।
১১। অনিচ্ছাকৃতভাবে গলায় মশা, মাছি, ধোঁয়া বা ধুলাবালি প্রবেশ করা।
১২। অনিচ্ছাকৃতভাবে কানে পানি প্রবেশ করা।
রোযার ফযিলতঃ
আবু হুরায়রা রাঃ বলেন, রসূল সাঃ এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে রমযানের রোযা রাখবে, তার পূবের সগীরা গুনাহসমূহ মাফ করা হবে এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে রমযানের রাত্রি ইবাদতে কাটাবে, তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। আর যে ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে ক্কদরের রাত্রি কাটাবে তার গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। (বুখারী ও মুসলীম)
রসূল সাঃ এরশাদ করেছেন,আল্লাহ তায়ালা বলেন মানব সন্তানের নেক আমল বাড়ানো হয়ে থাকে প্রত্যেক নেক আমল দশ গুন থেকে সাতশত গুন পর্যন্ত ,কেবল রোযা ব্যতীত। কারণ রোযা আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিফল দান করব (যত ইচ্ছা তত)। বান্দা আমারই জন্য আপন প্রবৃত্তি ও খানাপিনা ত্যাগ করে। রোযাদারের জন্য দুইটি (প্রধান)আনন্দ রযেছে। একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি বেহেস্তে আপন পরওয়ারদিগারের সাথে সাক্ষাত লাভের সময়। নিশ্চয় রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের খুশবো অপেক্ষাও অধিক সুগন্ধময়। রোযা হচ্ছে মানুষের জন্য দোযখের আগুন হতে রক্ষার ঢাল স্বরুপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারও রোযার দিন আসে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলেএবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন বলে আমি একজন রোযাদার। (বুখারীও মুসলীম)
রোযা মানব শরীরে কোন ক্ষতি করে নাঃ
১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজে ডাঃ গোলাম মোয়াজ্জাম সাহেব কর্তৃক মানব শরীরের উপর রোযার প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা চালানো হয়। তাতে প্রমানিত হয় যে, রোযার দ্বারা মানব শরীরের কোন ক্ষতি হয় না কেবল ওজন সামান্য কমে, তাও উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়। বরং শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে এইরুপ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রন তথা ডায়েট কন্ট্রোল অপেক্ষা বহুদিক দিয়ে শ্রেষ্ট। তৎকর্তৃক ১৯৬০ সালে গবেষণায় এটাও প্রমানিত হয় যে, যারা মনে করে থাকে যে, রোযা দ্বারা,পেটের শূল বেদনা বৃদ্ধি পায় তাদের এই ধারনা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক। কারন উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খেলেই এটা বাড়ে। এই অতি কথাটা অনেক চিকিৎসকই চিন্তা না করে শূল বেদনা রোগীকে রোযা রাখতে নিষেধ করেন। ১৭ জন রোযাদারের পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশী বা খুব কম, রোযার পরে তাদের এই উভয় দোষই সেরে গেছে। এই গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয় যে, যারা মনে করেন যে, রোযার দ্বারা রক্তের পটাশিয়াম কমে যায় এবং তাদের শরীরের ক্ষতি সাধন হয়, তাদের এই ধারণা ও অমূলক। কারন পটাশিয়াম কমার প্রতিক্রিয়া কম দেখা দিয়ে থাকে হৃদপিন্ডের উপর অথচ ১১ জন রোযাদারের হৃদপিন্ড অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রোকার্ডিগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে ( রোযার পূর্বেও রোযা রাখার ২৫ দিন পর) পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, রোযা দ্বারা এদের হৃদপিন্ডের ক্রিয়ার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি।
হে আল্লাহ যেভাবে রোজা পালন করলে তুমি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবে আমাদের সবাইকে সেভাবে রমজানের রোযা পালন করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
No comments:
Post a Comment